রপ্তানিতে সম্পূরক শুল্ক ফেরত প্রাপ্তি : আইনি প্রক্রিয়া ও সঠিক ব্যাখ্যা
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক আইন, ২০১২ এর আওতায় ৪ (চারটি) কর আদায় করা হয়।
১. ভ্যাট ২. টার্নওভার কর ৩. সম্পূরক শুল্ক ৪. আগাম কর। যদিও আইনের ধারা ২ (২৪) অনুযায়ী কর এর সংজ্ঞায় আগাম কর কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কারণ হচ্ছে আগাম কর প্রকৃত অর্থে কর নয় বরং আগাম কর হল জামানত। আমদানি স্তরে আগাম করকে জামানত হিসেবে জমা রাখা হয়। পরবর্তীতে আইনের ধারা ৩১ অনুযায়ী আগাম করকে হ্রাসকারী সমন্বয় অর্থাৎ ফেরত নেওয়া যায়। সম্পূরক শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অতিরিক্ত অর্থাৎ সাধারণ কর অতিরিক্ত হিসেবে যেই কর আদায় করা হয় তাই সম্পূরক শুল্ক। সম্পূরক শুল্ক সাধারণত বিলাসবহুল পণ্য সামাজিকভাবে অনভিপ্রেত পণ্য এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর আরোপ করা হয়। কোন কোন পণ্য ও সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক আলোকিত রয়েছে তা আইনের ২য় (দ্বিতীয়) তফসিলে বর্ণিত রয়েছে।
সম্পূরক শুল্কের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ব্যবসায়ী বা ট্রেডিং পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আরোপ হবে না এবং একই সাথে কোন পণ্যের উপর একাধিক পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আরোপ হবে না। সম্পূরক শুল্ক শুধুমাত্র একটি পর্যায়ে আদায় করা হয়। আইনের ধারা ৫৫ (৫) অনুযায়ী "কোন সম্পূরক শুল্ক আরোপ—যোগ্য পণ্য বা সেবা সরবরাহের উপর কেবলমাত্র একটি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক প্রদেয় হবে।"
ভ্যাট হচ্ছে একটি বহুস্তর বিশিষ্ট কর ব্যবস্থা। ভ্যাট ব্যবস্থায় আমদানি পর্যায়ে, উৎপাদন পর্যায়ে এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট আদায় করা হয় কিন্তু কোন একটি পণ্য বা সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয় উপরে বর্ণিত স্তর গুলোর মধ্যে শুধুমাত্র একটি স্তরে। অর্থাৎ যে পণ্যের ওপর আমদানি স্তরে বা উৎপাদন স্তরে সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়েছে, সে পণ্যের উপর ব্যবসায়ী স্তরে সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হবে না। প্রকৃত অর্থে, ব্যবসায়ী পর্যায়ে কোন পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপিত নেই। তবে আমদানিকৃত পণ্য বা উপকরণ উপর সম্পূরক শুল্ক আদায় হয়েছে অতঃপর উক্ত পণ্য বা উপকরণ ব্যবহার করে নতুন কোন পণ্য উৎপাদন করা হলে সে পণ্যের উপর যদি সম্পূরক শুল্ক আরোপিত থাকে সেক্ষেত্রে উৎপাদন স্তরে তা আদায় করতে হবে। কারণ এক্ষেত্রে পণ্যটি আর একই পণ্য থাকছে না বরং পরিবর্তিত হয়ে অন্য কোন পণ্যে রূপান্তরিত হয়।
আইনের ২য় (দ্বিতীয়) তফসিলে সম্পূরক শুল্কের হার উল্লেখ রয়েছে। সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য মূল্যের উপর সম্পূরক শুল্কের প্রযোজ্য হার গুণ করার মাধ্যমে সম্পূরক শুল্কের পরিমাণ নির্ণয় করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কেশ পরিচর্যায় ব্যবহৃত কোন একটি সামগ্রীর সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য মূল্য ৬৭ টাকা। এর ওপর সম্পূরক শুল্কের প্রযোজ্য হার ২০%। তাহলে এখানে সম্পূরক শুল্কের পরিমাণ হবে = ৬৭ * ২০% অর্থাৎ ১৩.৪০ টাকা। সম্পূরক শুল্কের আরোপযোগ্য মূল্য বলতে কোন পণ্যের প্রকৃত মূল্যকে বোঝানো হয় যাকে প্রায়ই পণ্যের সরবরাহ মূল্য হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
আইনের ভাষায় একটি পণ্যের পণ মূল্য হচ্ছে ওই পণ্যের সর্বশেষ মূল্য। পণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে পণ্য বা সেবার মূল্য, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, সুদ, জরিমানা, অর্থদণ্ড এবং সার্ভিস চার্জ [ধারা ২ (৫৯)]। পণ মূল্য থেকে ভ্যাটের পরিমাণ বিয়োগ করলে পণ্যের সরবরাহ মূল্য (প্রকৃত মূল্য) পাওয়া যায়। তাহলে আমাদের দেশের স্থানীয় সরবরাহের ক্ষেত্রে পণমূল্য থেকে ভ্যাটের পরিমাণ বিয়োগ করে যে মূল্য পাওয়া যায় সেই মূল্য থেকে সম্পূরক শুল্কের পরিমাণ বিয়োগ করলে সর্বশেষ যে মূল্য পাওয়া যায় তাই ওই পণ্যের সরবরাহ মুল্য (প্রকৃত মূল্য)।
এবার আসা যাক সম্পূরক শুল্ক সাধারণত কখন ফেরত দেয়া হয়। কখন ফেরত দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তা জানা দরকার। এখানে মূলত একটি পরিস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে।
যদি আমদানিকৃত পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করা হয় এবং যদি ওই পণ্য রপ্তানি করা হয় অথবা ওই পণ্য উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে অন্য কোনো পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করা হয়, তাহলে আমদানি পর্যায়ে পরিশোধ করা সম্পূরক শুল্ক প্রত্যর্পণ পাওয়া যাবে। এ কথা শুধু আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা নয়, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযাজ্যে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা কোনো পণ্যের ওপর যদি সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করা হয় এবং যদি পণ্যটি রপ্তানি করা হয়, তাহলে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যর্পণ পাওনা হয়। প্রত্যর্পণ গ্রহণ করার নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। প্রত্যর্পণ গ্রহণ করার পরিবর্তে মূসক দাখিলপত্রের (ভ্যাট রিটার্ন) মাধ্যমে প্রদেয় করের বিপরীতে তা হ্রাসকারী সমন্বয় করা যায়। ভ্যাট আইনের আওতার কর সমূহ (ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক) দাখিল পত্রের মাধ্যমে সমন্বয় করতে হয়। এবং কাস্টমস আইনের আওতার কর সমূহ (কাস্টমস ডিউটি, রেগুলেটরী ডিউটি) ডেডো (DEDO) থেকে প্রত্যর্পণ নিতে হয়।
এবার মূসক দাখিলপত্রের (ভ্যাট রিটার্ন) মাধ্যমে প্রদেয় করের বিপরীতে তা কিভাবে হ্রাসকারী সমন্বয় করা যায় তার পদ্ধতি জানা যাক। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বিধিমালা, ২০১৬ এর বিধি ৪৫ মোতাবেক -
আমরা আগেই জেনেছি যে যদি কোন পণ্য রপ্তানি করা হয় এবং ওই রপ্তানিকৃত পণ্য উৎপাদনে কোন আমদানিকৃত বা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত উপকরণ (কাঁচামাল) যার উপর সম্পূরক শুল্ক পূর্বে প্রদত্ত হয়েছে সেই সকল রপ্তানিকৃত পণ্য যে তারিখে রপ্তানির উদ্দেশ্যে কোন জাহাজ উড়োজাহাজ বা অন্য কোন জানে বোঝাই করা হয়েছে উক্ত তারিখ হতে ৬(ছয়) মাসের মধ্যে নিবন্ধিত ব্যক্তিকে হ্রাসকারী সমন্বয়ে করার উদ্দেশ্যে নির্ধারিত ফরম মূসক-৭.১ এর মাধ্যমে কমিশনারের নিকট আবেদন করতে হবে দাখিলপত্রের (মূসক-৯.১) মাধ্যমে ।
হ্রাসকারী সমন্বয় গ্রহণের সমর্থনে রপ্তানিকারকের বেশ কিছু দলিলাদি দখলে থাকতে হবে-
১. উপকরণ আমদানি ও ব্যবহারের নিশ্চয়তা প্রমাণের জন্য-
ü রিলিজ অর্ডার বা শুল্ক-কর পরিশোধের প্রমাণসহ পণ্য ঘোষণার কপি
ü ইনভয়েস ও প্যাকিং লিস্ট এর কপি
২. পণ্য রপ্তানির প্রমাণক হিসেবে যেসব দলিলাদি দখলে থাকতে হবে-
ü বিল অব লেডিং বা এয়ারওয়ে বিল এর কপি
ü এক্সপোর্ট জেনারেল মেনিফেস্ট (EGM) এর কপি
ü বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসন সনদ (PRC certificate)
উপরের উল্লেখিত দলিলাদি সমূহ পণ্যের উপকরণের আমদানি ও ব্যবহারের নিশ্চয়তা এবং উক্ত উৎপাদিত পণ্য যথাযথভাবে রপ্তানি হয়েছে কিনা তার প্রমাণক হিসেবে দখলে রাখতে হবে। রপ্তানিতব্য পণ্য জাহাজ উড়োজাহাজ বা অন্যকোন যানে বোঝাই করার ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে হ্রাসকারী সমন্বয় গ্রহণ করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মকর্তা কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে পরবর্তী ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে হ্রাসকারী সমন্বয় গ্রহণ করতে পারবেন।
বর্তমান মূসক আইনে রপ্তানিকারককে উৎসাহিত করার জন্য এ ধরনের অবারিত সুযোগ-সুবিধা আইন ও বিধিতে বিদ্যমান রয়েছে। তাই আমাদের সকলের উচিত মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন ও বিধিমালা সঠিকভাবে প্রতিপালন করা এবং মূসক সংক্রান্ত ঝুঁকি এড়িয়ে চলা।