2. চিকিৎসা সেবা ভ্যাটমুক্ত বনাম উৎসে ভ্যাট কর্তন বাস্তবতা ও আইনগত বাধ্যবাধকতা|
আমাদের সকলেরই এ বিষয়ে ধারণা আছে যে চিকিৎসা সেবার ওপর ভ্যাট নেই। চিকিৎসা সেবার উপর একসময় ভ্যাট ছিল। পরবর্তীতে মহামান্য উচ্চ আদালতের আদেশে তা বাতিল হয়ে যায়। Reference. (High Court Division, Writ petition No. 1190/2009. Mr. Manzil Morshed, petitioner vs Bangladesh and others, respondent. DLR- 15 BLC 351) তাই এখন আমরা সবাই জানি যে, চিকিৎসা সেবা অর্থাৎ হাসপাতালে উপর ভ্যাট নেই। কিন্তু, এখানে অন্য আরেকটি বিষয় জড়িত রয়েছে। সেটি হচ্ছে, উৎসে ভ্যাট কর্তন। আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষের নিকটই চিকিৎসা সেবা বা হাসপাতালের উপর উৎসে ভ্যাট কর্তনের বিষয়টি বোধগম্য নয়।
মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এর ধারা ২(২১)(ঙ) অনুযায়ী কোন লিমিটেড কোম্পানি উৎসে কর কর্তনকারী সত্তা এবং ২(২১)(চ) অনুযায়ী ১০ কোটি টার্নওভার রয়েছে এমন কোন প্রতিষ্ঠান ও উৎসে কর কর্তনকারী সত্তা হবেন। আমাদের দেশের অনেক হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত রয়েছে এছাড়াও তাদের মধ্যে অনেকের বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ ১০ কোটি টাকার অধিক। সুতরাং প্রায় সকল হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার মূসক আইন অনুযায়ী উৎসে কর কর্তনকারী সত্তা।
আইনের ধারা ২(৪২) মোতাবেক টার্নওভার বলতে কোন ব্যক্তি কর্তৃক কোন নির্দিষ্ট সময়ে বা কর মেয়াদে করযোগ্য সরবরাহকৃত পণ্য বা সেবা বাবদ প্রাপ্ত বা প্রাপ্য মোট অর্থের পরিমাণ। ধারা ২(৩২) মোতাবেক করযোগ্য সরবরাহ হচ্ছে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সরবরাহ ব্যতীত অন্য যেকোনো সরবরাহ। অব্যাহতি প্রাপ্ত সরবরাহ হচ্ছে আইনের প্রথম তফসিলে উল্লেখিত অব্যাহতি প্রাপ্ত পণ্য ও সেবা সমূহের তালিকা। অব্যাহতিপ্রাপ্ত কোন সরবরাহের মূল্য বা মূলধনী সম্পদের বিক্রয় মূল্য বা প্রতিষ্ঠানের অংশ বিশেষের বিক্রয় মূল্য এসব টার্নওভারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে না। সাধারণ অর্থে কর যোগ্য সরবরাহের মূল্যই হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার।
যেহেতু এ সকল প্রতিষ্ঠান উৎসে কর্তনকারী সত্তা তাই মূসক কর্তৃপক্ষ তাদের সিএ অডিট রিপোর্ট এর ভিত্তিতে ভ্যাট অডিট পরিচালনা করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত সেবার উপর প্রদয় ভ্যাট না থাকার কারণে মূসক কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র সঠিকভাবে উৎসে কর্তনের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করা হয়েছে কিনা সেটা নিরীক্ষা করেন।
এ সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় উৎসে কর কর্তন করতে হয় সেটা বুঝতে পারাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রচুর পরিমাণে স্থানীয় ভাবে (দেশের মধ্যে থেকে) বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয় করে থাকে। এমন অধিকাংশ ক্রয়ের ক্ষেত্রে ঐ প্রতিষ্ঠানের উৎসে কর কর্তনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বর্তমানে এসআরও নং- ১৮২- আইন/২০২৫/৩১০-মূসক; তারিখ: ২৭ মে, ২০২৫ উৎসে মূল্য সংযোজন কর কর্তন ও আদায় বিধিমালা, ২০২৫ মোতাবেক ৪৪ টি সেবার খাত থেকে সেবা গ্রহণের বিপরীতে উৎসে কর কর্তনের বিধান অবশ্য পালনীয়। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্তৃপক্ষ এ সকল সেবা গ্রহণের বিপরীতে উৎসে কর কর্তনের বিধানের ব্যাপারে সম্ম্যক জ্ঞান না থাকায় সঠিকভাবে হচ্ছে কর কর্তন করেন না। এর ফলাফল হিসাবে যখন ওই সকল প্রতিষ্ঠান ভ্যাট অডিটের সম্মুখীন হয় তখন নিরীক্ষায় অনেক বড় অংকের অপরিশোধিত উৎসে কর্তনের পরিমাণ বের হয়ে আসে। এ নিয়ে আবার প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সাথে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। কারণ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের উৎসে কর্তনের ব্যাপারে অপর্যাপ্ত জ্ঞানের দরুন মনে করেন যে, যেহেতু তাদের প্রদত্ত সেবার উপর ভ্যাট প্রদান করতে হয় না সুতরাং অপরিশোধিত উৎসে করের পরিমাণ কিভাবে বের হলো।
সাধারণত দেখা যায় যে, এ সকল প্রতিষ্ঠান যেসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্থানীয় ভাবে (দেশের মধ্যে থেকে) ক্রয় করে থাকে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উৎসে কর কর্তনের বিধান অবশ্য পালনীয়। তাই হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের উৎসে কর কর্তনের বিষয়ে জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নতুবা এ সকল প্রতিষ্ঠান মূসক কর্তৃপক্ষের পরিচালিত ভ্যাট অডিটে বেশ বড় অংকের অপরিশোধিত উৎসে কর উদঘাটিত হবে। যেখানে মূসক কর্তৃপক্ষ আইনের ধারা ৭৩ অনুযায়ী অপরিশোধিত উৎসে কর নির্ধারণ করবেন এবং ধারা ৮৫ ও বিধি ৬৫ অনুযায়ী জরিমানা আরোপ করবেন। এছাড়া আইনের ধারা ৮৫(১)(১ক)(অ) এবং ধারা ১২৭ মোতাবেক ষান্মাসিক ২% (দুই) সরল হারে সুদসহ অপরিশোধিত উৎসে কর আদায় করবেন। এছাড়াও ৮৫(১)(১ক)(আ) মোতাবেক সংশ্লিষ্ট উৎসে কর কর্তনকারী ব্যক্তি, কর্তনকৃত উৎসে কর জমা প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তাকে অনধিক ২৫,০০০ (পঁচিশ হাজার) টাকা এবং আইনের বিধি ৬৫(২)(খ) মোতাবেক অন্যূন ১০,০০০ (দশ হাজার) অনূর্ধ্ব ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) টাকা ব্যক্তিগত জরিমানা করতে পারবেন। তাই এ সকল হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের উৎসে কর কর্তনের বিধিমালা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যকীয়।